
রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধু ধর্মীয় অনুশাসনই নয়, বরং এর মাধ্যমে মানবদেহ ও মনের নানাবিধ উপকার সাধিত হয়। রোজার মাধ্যমে আমরা আত্মশুদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি।
রোজা মেদ কমাতে সহায়ক
রোজা থাকার ফলে দেহের অতিরিক্ত চর্বি কমতে থাকে। আমরা সচরাচর খবারে থাকা গ্লুকোজ থেকে শক্তি নিয়ে চলাচল করি। কিন্তু রোজায় পাকস্থলি খালি থাকায় দেহে গ্লুকোজ তৈরি কম হয়। ফলে পাকস্থলিতে খবার না থাকায় দেহের অতিরিক্ত চর্বি গলে (ফ্যাট বার্নিং) মানুষ চলাফেরার শক্তি অর্জন করে। তাই মেদ ও ওজন কমে যায়।
গ্যাস্ট্রিক ও আলসার সমস্যায় রোজা
গ্যাস্ট্রিক ও আলসার সমস্যা উপশমে রোজা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। গবেষণা বলছে, দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার ফলে দেহে ইন্টেস্টিনাল স্টেম সেলগুলো তৈরি হয় এবং আমাদের পেটের আলসার হিলিং হয়ে লিকি (Leaky) গাটস (Guts) ভালো রাখতে সহায়তা করে। লিকি-গাটসের কারণে এক ধরণেন অ্যালার্জি হয়। যা পেটে হেলিকোব্যাক্টর পাইলেরি (H. Pylori) নামক আলসারের সৃষ্টি করে৷ তবে খাবার বিরতি বা রোজা এ জীবাণুকে ধ্বংসে সাহায্য করে।

হৃদরোগ ও লিভার সুরক্ষায় রোজা
হৃদরোগের প্রধান কারণ হলো রক্তনালিতে চর্বি জমে গিয়ে হার্টে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া। সাধারণত শরীরে চর্বি জমে যাওয়ায় এ ধরণের ঘটনাগুলো ঘটে। উচ্চ রক্তচাপ ও ওজন বেড়ে যাওয়াও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। একইভাবে লিভারে চর্বি জমে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায়। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোজার উপকারিতা লক্ষণীয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের শরীরে এইচডিএল এবং এলডিএল পাওয়া যায়। এইচডিএল এমন ফ্যাট, যা বহু রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। বিপরীতে এলডিএল, যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক। তবে রোজা যেমন রক্তনালিগুলোকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে, তেমনি শরীর থেকে চর্বি গলার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। যা হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য খুবই উপকারী।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রোজা
রোজা রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। দেখা গেছে, রোজা রাখার ফলে প্রাথমিক রোগী (প্রি ডায়াবেটিক) ও টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীদের কোন ঔষধ ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এমনকি যাদের ইনসুলিন নিতে হয়, তাদের ইনসুলিন নেওয়ার মাত্রা কমে আসে।
ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে রোজা
দেহে উৎপাদিত গ্লুকোজ ক্যান্সার কোষের প্রধান খাদ্য। গ্লুকোজ অনেকগুলো ব্যাকটেরিয়ার মিডিয়া, অর্থাৎ বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাশাপাশি ক্যান্সার সেলগুলোকেও বাড়তে সহায়তা করে। তাই খাবারের দীর্ঘ বিরতির তথা অটোফেজির মাধ্যমে ক্যান্সার কোষগুলো আকারে ছোট হয়ে যায়। এসময় ব্যায়াম করলে দেহে প্রাকৃতিক কিলার সেল উৎপন্ন হয়, যা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে, না খেয়ে থাকার ফলে গ্রোথ হরমোন বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের খারাপ উপাদান নষ্ট করে ভালো উপাদান বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
ত্বকের যত্নে রোজা
রোজা রাখা ত্বকের জন্য উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ খাবার বিরতি দেয়ার ফলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং অ্যান্টি এজিং প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। কারণ অটোফেজি প্রক্রিয়ায় দেহের অপ্রয়োজনীয় ও নষ্ট কোষগুলো ধ্বংস হয়ে পুনরায় নতুন স্বাস্থ্যকর কোষ ও টিস্যু তৈরি হয়। আর পুরো এক মাস রোজা রাখলে এই প্রক্রিয়া আরো ভালোভাবে সম্পন্ন হতে পারে। দেহ নতুন কোলাজেন তৈরি করে। তাই ত্বক আরো উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে।
রোজাতে মিলে মানসিক প্রশান্তি
রোজা রাখলে যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থেকে মনে আল্লাহ ভীতি এবং তাকে স্বরণ করার মানসিকতা তৈরি হয়। অতিরিক্ত চিন্তা থেকে মস্তিষ্ক শান্ত থাকে। ফলে মনে প্রশান্তি আসে। ডা. আইজাক জেনিংস বলেছেন, ‘যারা আলস্য ও গোঁড়ামির কারণে এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনী শক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোজা তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করে।
ইসলামে রোজার গুরুত্ব
ইসলামে রোজার গুরুত্ব অনেক। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা পরহেজগার ও আল্লাহভীরু হতে পারো।’
রোজা মূলত তাকওয়া অর্জনের শিক্ষা দেয়। ফলে সকল গুনাহ থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী করা যায়। তাই রোজার মাহত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে-
রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের নিকট রমজান মাস উপস্থিত। এটা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ তা’য়ালা এ মাসে তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় শয়তানগুলোকে আটক রাখা হয়। আল্লাহর জন্যে এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহা কল্যাণলাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি।” (সুনানুন নাসায়ী: ২১০৬)

রোজার পুরস্কার ঘোষণা করে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বলা হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ (সো:) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পর্যালোচনাসহ রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুণাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহীহ বুখারী: ৩৮, সহীহ মুসলিম: ৭৬০)
মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুর যাকাত আছে; শরীরের যাকাত হলো রোজা’।
তাই পবিত্র এই মাহে রমজানে শরীর ও মনকে সুস্থ্য রাখার পাশাপাশি আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জন করতে রোজার কোন বিকল্প নেই। অতএব, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা পালন করলে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি খোদাভীতির পথ সহজ হবে। তাই আমাদের রোজা রাখা উচিত।