মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ১০টি উপায়।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ১০টি উপায় নিচে দেওয়া হলো

 

০১) আপনার ভালো লাগা কাজ করুন

মানসিক চাপ থেকে মুক্তির এক অদ্ভুত উপায় লুকিয়ে আছে আপনার পছন্দের কাজের মধ্যে। গান শোনা, বই পড়া, ছবি আঁকা, বাগান করার মতো যেসব কাজ আপনার মনকে আনন্দ দেয়, সেগুলোই হতে পারে আপনার মানসিক  চাপের প্রতিষেধক।

 

কারণ যখন আপনি প্রিয় কাজে মনোনিবেশ করবেন, তখন মস্তিষ্ক ডোপামিন নামক এক ধরণের নিউরো ট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে। এই ডোপামিন আপনাকে ভালো অনুভূতি বোধ করতে সাহায্য করবে, আর আপনার মানসিক  চাপ কমিয়ে দিবে।

এছাড়াও, পছন্দের কাজ মনকে শান্ত করে, একাগ্রতা বাড়ায় এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। তাই যখন চাপে ভুগবেন, তখন বসে না থেকে একটু ব্রেক নিবেন। তারপর আপনার প্রিয় গান শুনবেন, মনো মুগ্ধকর কোন বইয়ের পাতায় চোখ রাখবেন, অথবা প্রিয় খেলায় হারিয়ে যাবেন। দেখবেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার মন ভালো হয়ে উঠবে, সেইসাথে আপনার মানসিক চাপও কমে যাবে।

০২) চুইংগাম চিবাবেন

চুইংগাম চিবানোর সময়, আপনার মুখের পেশী গুলো নিয়মিত নড়াচড়া করে। এতে মুখের রক্ত ​​সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহও বৃদ্ধি পায়। প্রচুর অক্সিজেন সরবরাহের ফলে মস্তিষ্ক আরও সক্রিয় ও সজাগ থাকে, যার ফলে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, চুইংগাম চিবানো ব্যক্তির মেমরি, প্রতিক্রিয়া এবং সতর্কতা ধরন উন্নত হয়। এর কারণ হল চুইংগাম চিবালে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ সক্রিয় থাকে যা মনোযোগ, মেমরি এবং শেখার বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে।

০৩) যোগ ব্যায়াম করুন

যোগ ব্যায়ামে প্রাণায়াম অনুশীলন শ্বাস প্রশ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে। গভীর ও ধীর শ্বাস প্রশ্বাস মন কে শান্ত করে এবং চাপ কমাতে সাহায্য করে। এই ব্যায়াম আমাদের মননশীলতা বৃদ্ধি করে। আর এই মননশীল অবস্থায় আপনি বর্তমান সময়ের উপর মনোযোগ দিতে পারবেন এবং অতীত বা ভবিষ্যতের চিন্তা থেকে মুক্তি নিতে পারবেন। যা আপনার মানসিক চাপ কমাতে এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।

০৪) ভ্রমণ করুন

যখন আমরা প্রকৃতির কোলে ফিরে যাই, তখন মনে হয় যেন এক অদ্ভুত শান্তি এসে ভরে যায়। কারণ এই সময় আমাদের মন শান্ত হয়ে যায়, চিন্তাভাবনা থেমে যায়। নীল আকাশ, সবুজ গাছপালা, মৃদু বাতাস – এই সবকিছুই আমাদের মনকে হালকা করে তোলে। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন অভিজ্ঞতা – এই সবকিছুই আমাদের মনকে প্রফুল্ল করে।এর ফলে আমাদের মানসিক চাপ কমে যায়, সেইসাথে আমাদের মন ভালো হয়।

কারণ, ভ্রমণের সময় আমরা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি না,এর পাশাপাশি নতুন অভিজ্ঞতাও অর্জন করি। নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হই, তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানি। নতুন নতুন খাবার খাই, নতুন নতুন জিনিস দেখি। এই সবকিছুই আমাদের সবার মনকে করে তোলে সমৃদ্ধ। যার ফলে আমাদরে মানসিক চাপ কমে যায় এবং জীবনে আসে নতুন উৎসাহ।

০৫) প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ রাখুন

প্রিয় মানুষেরা আমাদের ভালোবাসে, আমাদের পাশে থাকে। তাদের সাথে কথা বললে, সময় কাটালে আমরা এই ভালোবাসা ও সমর্থনের অনুভূতি পাই। এতে আমাদের মন ভালো হয়, চাপ কমে। মনের মধ্যে চাপ থাকলে, সমস্যা থাকলে প্রিয়জনের সাথে খুলে বললে আমরা অনেকটা হালকা বোধ করি। মনে হয়, আমাদের বোঝার মতো অনেক মানুষ আছে, যারা আমাদের পাশে আছে। যা থেকে আমরা মানসিক প্রশান্তি পাই।

০৬) মোবাইল কম্পিউটার থেকে দুরে থাকুন

আধুনিক জীবনে আমরা প্রায়শই ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে আবদ্ধ থাকি। স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট – নোটিফিকেশন, আপডেট এবং ভার্চুয়াল জগতের আকর্ষণ আমাদের মনোযোগ টেনে ধরে। কিন্তু এই অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে অনেকেরই মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের “নিখুঁত” জীবন দেখে হতাশা, কাজের বার্তা ও ইমেলের চাপ, এবং সর্বদা সংযুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি – এই সবকিছু মিলিয়ে আমাদের মন অস্থির ও চটপটে হয়ে ওঠে।

 

লেখক ক্রিস্টিন কার্লসন তার বই “ডোন্ট সোয়েট দ্য স্মল স্টাফ”-এ যুক্তি দেখিয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট জানার জন্য বারবার ফোন চেক করা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। তাই আপনি যদি আপনার মানসিক চাপ কমাতে চান, তাহলে অবশ্যই এই ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে নিজেকে দুরে রাখার চেস্টা করবেন।

০৭) পোষা প্রাণীর সাথে সময় কাটান

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পোষা প্রাণীর সাথে সময় কাটানোর মাধ্যমে আমাদের শরীরে কর্টিসোল নামক হরমোনের নিঃসরণ কমে। কর্টিসোল হলো মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রনকারী চাপের হরমোন। যখন আমরা চাপ অনুভব করি, তখন আমাদের শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘমেয়াদী চাপের ফলে কর্টিসোলের অতিরিক্ত মাত্রা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে দেয়।

 

কিন্তু পোষা প্রাণীর সাথে খেলাধুলা, তাদের স্পর্শ এবং তাদের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরে অক্সিটোসিন নামক হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। অক্সিটোসিন কে “ভালোবাসার হরমোন”ও বলা হয়। এই হরমোন আমাদের মনে শান্তি ও প্রশান্তির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। কর্টিসোলের বিপরীতে, অক্সিটোসিন রক্তচাপ কমাতে, হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমাতে সাহায্য করে।

০৮) ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করুন

ইসলামে মানসিক শান্তি অর্জনের জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তাকদিরের উপর বিশ্বাস রাখা মুমিনদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ সূরা বাকারার ১৫৫-১৫৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব, সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও, যাদের ওপর কোন বিপদ এলে বলে, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’।”

 

তবে ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মেও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এমন অনেক অনুশীলন রয়েছে। খ্রিস্টানরা প্রার্থনা, গান গাওয়া এবং বাইবেল পাঠ করেন। হিন্দুরা ধ্যান, যজ্ঞ এবং মন্দিরে যান। বৌদ্ধরা ধ্যান, মন্ত্রপাঠ এবং সঙ্গীত শোনেন। মনে রাখবেন, ধর্মীয় অনুশীলন হলো ব্যক্তিগত বিষয়। তবে আপনার জন্য কোন ধর্মীয় অনুশীলনটি সবচেয়ে কার্যকর তা নির্ধারণ করতে আপনাকে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশীলন সম্পর্কে জানতে হবে এবং আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে ভালো কাজ করবে তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

০৯) ডায়েরী লেখার অভ্যাস করুন

আধুনিক যুগে, স্মার্টফোন এবং ডিজিটাল ডিভাইসের আধিপত্যের কারণে কাগজ-কলমে লেখার অভ্যাস ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা যে, এই সহজ অভ্যাসটি মনের অশান্তি দূর করে অপার প্রশান্তি এনে দিতে পারে।

 

মনে ভারী কোনো চিন্তা থাকলে, কোনো বিষয়ে কষ্ট পেলে, প্রতিদিনের ছোটো বড়ো ঘটনা, আনন্দ বেদনার স্মৃতি – সবকিছু তারিখসহ ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। এটি কেবল স্মৃতি ধরে রাখার মাধ্যম নয়, বরং অনেকদিন পর পুরনো ডায়েরি খুলে পড়লে পুরনো স্মৃতি মনে করে এক অপূর্ব আনন্দ অনুভব করবেন।

 

কিন্তু ডায়েরি লেখার গুরুত্ব শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।  নিয়মিত ডায়েরি লেখার মাধ্যমে মনের ভেতরের চাপ অনেকটাই কমে যায়। কারণ ডায়েরিতে লেখার সময় আমরা আমাদের চিন্তা ভাবনা গুলো কে স্পষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারি। এতে আমাদের মনের অস্পষ্টতা দূর হয় এবং সমস্যা গুলোর সমাধানের পথ খুঁজে পেতে সহজ হয়।

১০) বই পড়ার অভ্যাস করুন

একটি ভালো বই আপনাকে নিয়ে যেতে পারে এক অপূর্ব জগতে। সেখানে আপনি ভুলে যেতে পারবেন সকল চিন্তা-ভাবনা, দুশ্চিন্তা। বইয়ের পাতায় আপনি হারিয়ে যাবেন নতুন নতুন গল্পের মধ্যে, যার চরিত্র গুলোর সাথে আপনার মন একাত্ম হয়ে যাবে। আর যখন মন ভালো থাকে,তখন নতুন কোনো দুশ্চিন্তার সুযোগ থাকবেনা।

 

কারন বইয়ের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি নতুন নতুন তথ্য, ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি। এতে আমাদের চিন্তা ভাবনার জগৎ প্রসারিত হয় এবং আমরা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে নতুন নতুন উপায় আবিষ্কার করতে পারি। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। নতুন নতুন গল্প ও চরিত্র আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জাগায় এবং আমাদের নিজস্ব জীবনেও নতুন কিছু করার ইচ্ছা জাগ্রত করে।